facebook icon

করোনাকালে ঘনিষ্ঠ চারজন মারা যান, তখন থেকেই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নাফিসার

আশরাফ আন নূর প্রকাশ: 16 May 2025, 07:55 PM , আপডেট: 23 June 2025, 10:00 PM
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থী নাফিসা
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থী নাফিসা   © টিডিসি ফটো

নাফিসা বিনতে খলীল পড়ছেন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে। গ্রামের বাড়ি নাটোরে। সেখান থেকে এসএসসি পাস করেন ২০১৮, এইচএসসি ২০২০ সালে। পরে এমবিবিএস ভর্তি হন ২০২১ সালে। এখন তিনি কলেজের একজন ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থী। ক্লাস ফাইভ, ক্লাস এইট, এসএসসি এবং এইচএস—সব পর্যায়েই পেয়েছেন বৃত্তি। ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তার রোল ছিল টানা ১ নম্বর। একাদশ শ্রেণিতে রাজশাহী থেকে নাফিসা করেন বোর্ড স্ট্যান্ড। তিনি ১৩০০ নাম্বার মধ্যে  ১২৬১ নাম্বার পেয়ে মেয়েদের মাঝে হন দ্বিতীয়। মা-বাবা ও ছোট ভাই নিয়ে নাফিসার ৪ সদস্যের পরিবার। নাফিসা বিনতে খলীল তার মেডিকেল জীবনের নানা কথা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের নিকট তুলে ধরেন। তার সঙ্গে কথা বলেছেন আশরাফ আন নূর।
 
মেডিকেল জীবন বেছে নেবার কারণ
নাফিসা বলেন, মেডিকেল জীবন বেছে নেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো—এটি একটি মহৎ ও মানবসেবামূলক পেশা। আমি সব সময়ই সাদা এপ্রোনের প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ অনুভব করতাম। কোভিড-১৯ মহামারির সময় আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠ চারজন মানুষ মারা যান। সেই সময়টা আমার কাছে গভীর দুঃখের হলেও, আমার ভেতরের চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছেটা আরও প্রবল করে তোলে। ছোটবেলা থেকেই আমি একটু প্যাশনেট ছিলাম। বিশেষ করে বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলো আমাকে খুব টানতো। আমার মা-বাবা সবসময়ই আমাকে এই পথ বেছে নিতে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাদের কোনো চাপ ছিল না—বরং ছিল নিঃশর্ত সাপোর্ট ও ভালোবাসা। তারা ছোটবেলা থেকেই বলতেন, ‘তুমি একজন ভালো ডাক্তার হবে।’ আমি সেই স্বপ্নকে নিজের ভেতরে লালন করেছি। 

আরও পড়ুন: চার শিক্ষার্থীর চোখে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ

অ্যাডমিশন টেস্ট
ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে নাফিসা বলেন, অ্যাডমিশন টেস্টে একটি মেডিকেল জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। আমি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ২০২১ সালে ভর্তি হই। সবারই মেডিকেলের এ্যাডমিশন টেস্ট এক সাথে হয়। কিন্তু নাম্বারের উপর ভিত্তি করে কলেজ সিলেকশন হয়।সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ ২০২৫, যে কয়টা ব্যাচ বের হয়েছে তারা সবাই ভাল করেছেন। আমার এখানে অ্যাডমিশন টেস্টের মার্ক ছিল ৭৬.৭৫। সময়টা অনেকেই ঠিকমতো ধরতে পারে না কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। এসময় পড়াশোনাটা নিজের মতো করে গোছাতে না পারলে খুব সহজেই অনেকে খেই হারিয়ে ফেলে। তাই এই সময়টাতে সবারই সচেতনভাবে, লক্ষ্য ঠিক রেখে এগিয়ে যাওয়া জরুরি।

প্রথম বর্ষের চিত্র
মেডিকেল জীবনের প্রথম বর্ষের কথা বলতে গিয়ে নাফিসা বলেন, এসময় সবার মতো আমিও একেবারে নতুন ছিলাম। আমি উত্তরবঙ্গ থেকে এসেছি। ঢাকা এসে তাও আবার হোস্টেলে। এখানে এসে সেটআপ হতে সময় লেগেছে। নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশ। আবার সেই সঙ্গে হোস্টেল একটু ভিন্ন ছিল। আর এই সময় আমাদের অনেক বেশি প্রেসার থাকে। প্রথম বর্ষে আমাদের ক্লাস থাকে ৮ টা থেকে ২.৩০ পর্যন্ত। এখানে ৮ টা থেকে ৯ টা পর্যন্ত ক্লাস মাঝে লেকচার ও শেষে একটা আইটেম। আর থার্ড ইয়ারে ওয়ার্ডে প্রথম ক্লাস শুরু হয়। এ সময় ৯টা ৩০ মিনিট থেকে ১১ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত থাকে ওয়র্ডের টাইম।  এসময় শিক্ষার্থীরা ওয়ার্ডে কাজ করে। বাকি সময়ে লেকচার ও আইটেমগুলো হয়। 

তিনি আরও বলেন, মেডিকেল শিক্ষাক্রম মোট পাঁচ বছর মেয়াদী হলেও তার সময়বিন্যাস একটু আলাদা। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ মিলিয়ে সময় ধরা হয় দেড় বছর। এরপর তৃতীয় বর্ষ এক বছর, চতুর্থ বর্ষও এক বছর, আর শেষের ফাইনাল ইয়ার হয় দেড় বছর মেয়াদী। এইভাবে ধাপে ধাপে পাঁচ বছরের অ্যাকাডেমিক যাত্রা সম্পন্ন করতে হয় প্রতিটি শিক্ষার্থীকে।

প্রতিদিনই চলে পরীক্ষা যুদ্ধ
মেডিকেলে ভর্তির পরপরই শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ওয়ার্ডে গিয়ে রোগী পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে হাতে-কলমে শেখানো হয়, পাশাপাশি চলে লেকচার ও নিয়মিত আইটেম পরীক্ষা। প্রতিটি আইটেম পরীক্ষায় ১০ নম্বরে কমপক্ষে ৬ পেতে না পারলে পরবর্তী পরীক্ষায় বসা যায় না। কয়েকটি আইটেম পাশ করলে ‘কার্ড’ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ মেলে আর দুটি কার্ড মিলেই হয় একটি ‘টার্ম’। কার্ডে পাশ না করলে টার্মে, আর টার্মে পাশ না করলে প্রফেশনাল (প্রফ) পরীক্ষায় অংশ নেওয়া যায় না। কার্ডে শুধু রিটেন পরীক্ষা থাকলেও টার্ম ও প্রফে রিটেনের পাশাপাশি ভাইভা ও প্র্যাকটিক্যালও দিতে হয়। প্রতিটি পর্যায়ে পাশের জন্য প্রয়োজন অন্তত ৬০% নম্বর। নাফিসা বলেন, এক ধাপ ফেল করলে পরের ধাপে যাওয়া যায় না—এই ধারাবাহিক চাপটা মাথায় নিয়েই আমাদের এগোতে হয়।

আরও পড়ুন: ঢামেক হাসপাতাল ঘিরে ফুটপাত দখল, দেখার কেউ নেই

চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করা
নাফিসা বলেন, আমি সব সময় চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি। মেডিকেল জীবনও একধরনের বিশাল চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমি জানি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মধ্যে দিয়েই আমি মানুষ হিসেবে আরও বড় হতে পারব। অ্যাকাডেমিক জীবনেও আমি সবসময় সেরা হওয়ার চেষ্টা করেছি। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসেই আমি প্রথম স্থান অধিকার করেছি। একাদশ শ্রেণিতে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড থেকে আমি বোর্ড স্ট্যান্ড করি—মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করি। আমার নম্বর ছিল ১২৬১, যেখানে বোর্ডে সর্বোচ্চ নম্বর ছিল ১৩০০।

মেডিকেল জীবনে বন্ধুত্ব
নাফিসার মতে, মেডিকেল জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়টি হলো প্রথম বর্ষ। নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু, নতুন শিক্ষকদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সহজ নয়। তার ওপর বাংলা মাধ্যম থেকে আসা শিক্ষার্থীদের হঠাৎ ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা শুরু করাটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। সিলেবাসও অনেক বিস্তৃত যা শুরুতে ভীষণ চাপ তৈরি করে।

মেডিকেল জীবনের শুরুতেই গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব—বিশেষ করে প্রথম বর্ষে এই বন্ধন অনেকটাই আন্তরিক ও প্রাণবন্ত থাকে। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে এসে অনেক সময় এই সম্পর্কগুলোর মধ্যে ফাটল ধরে। নাফিসার ভাষায়, ‘প্রথম দিকে সবার সাথেই খুব ঘনিষ্ঠতা হয়, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা-ভাবনার পার্থক্য, মতের অমিল আর জীবনের সঙ্গে মিল না থাকার কারণে অনেক বন্ধুত্ব আর আগের মতো থাকে না।’ কারো সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় আবার কেউ কেউ সত্যিই পরিণত হন সোলমেটের মতো আপন একজন বন্ধুতে। যাদের বন্ধুত্ব টিকে যায়,তাদের মধ্যে তৈরি হয় অসাধারণ এক বন্ডিং যা শুধু আবেগে নয়—পড়াশোনায়ও সহায়ক হয়। ‘আমরা দল বেঁধে গ্রুপ স্টাডি করি, কেউ পিছিয়ে থাকলে সবাই মিলে তাকে সহায়তা করি। মেডিকেলে সিজিপিএ ভিত্তিক প্রতিযোগিতা না থাকায় সহযোদ্ধা হয়ে ওঠে সবাই। কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও পাশে দাঁড়ায় বন্ধুরা—কেউ অসুস্থ হলে কিংবা ডিপ্রেশনে থাকলেও তারা একে অপরের শক্তি হয়ে ওঠে।

মেডিকেল জীবনের শখ
নাফিসা বলেন, আমি যদি কোন কোন কাজে থাকি তখন ভাল লাগে। এখন পড়াশনার বাহিরে কিছু কাজ করি। আমি সাধারণত পড়াশোনার বাহিরে গান, নাচ, কবিতা আবৃত্তি ও বিতর্ক ও উপস্থাপনা করতে ভাল লাগে। একই সঙ্গে মাঝেমাঝে অভিনয়টাও পছন্দের। এসব সৃষ্টিশীল কাজ করে আমি উপজেলা, জেলা,বিভাগীয় ও জতীয় পর্যায়ের পুরস্কার পেয়েছি। তবে আমার সখ বিতর্ক করা। সেজন্য ডিবেট ক্লাবে কাজ করা পছন্দ করি। বর্তমান আমি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিবেট ফেডারেশনের জয়েন্ট অর্গানাইজিং সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করছি। 

ক্রিয়েটিভ কাজ পছন্দ করা
মেডিকেলে জীবনের ক্রিয়েটিভ কাজ তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি আসলে ডেডিকেটেড ছিলাম, আমার যদি কিছু পাইতে হয় তাহলে আমাকে কিছু হারাতে হবে। আমার চান্স পাওয়ার আগে কোন পারসোনাল ফোন ছিল না। এখন ফোনসহ অনেক কিছুই আছে। এইগুলোর পিছনে অনেক সময় চলে যায়। ফলে সৃষ্টিশীল কাজে সময় বেশি দিতে পারিনা। আামার পরামর্শ হলো ইন্টার লাইফের পূর্ব পর্যন্ত কোন শিক্ষার্থীই ফোন চালানো উচিত না। আমাকে মনে রাখতে হবে যে আমাকে যদি অন্য ১০ জন থেকে আলাদা হতে হয় তাহলে অন্য ১০ জনের চেয়ে বেশি ইফর্ট দিতে হবে। তবে আমার পারসোনাল কম্পিউটার ছিল। এর মাধ্যমে আমি  প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো শিখতাম। আমার কাছে মনে হতো যে ছেলারা ভাবে তারা মেয়েদের থেকে প্রযুক্তিগত শিক্ষায় আগানো। সেই দিকটা বিবেচনায় রেখে আমি প্রযুক্তিতগত শিক্ষায় উন্নতি করতাম। 

আরও পড়ুন: রোবটিক চিকিৎসার হাব হচ্ছে ঢাকা: স্বাস্থ্যখাতে চীনা বিনিয়োগে নতুন দিগন্ত

মেডিকেল জীবনে বিয়ে
নাফিসা বলেন, ‘মেডিকেলে অনেকেই আছেন যারা প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষেই বিয়ে করে ফেলেন। আবার কেউ কেউ এমবিবিএস শেষ করে বিয়ের কথা ভাবেন। এই পেশায় স্ট্রেস ও ব্যস্ততা অনেক বেশি। তাই অনেক সময় বয়স বেড়ে যায়। ফলে বিয়েটাও পিছিয়ে যায়। চিকিৎসকদের মানসিকতা ও জীবনধারা অনেকটাই মিল হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তাররাই একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ ধারায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন মেডিকেল শিক্ষার্থীরা সেনাবাহিনীর অফিসার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ব্যাংকারসহ অন্যদের সঙ্গেও বিয়ে করছেন। দুইজনে স্ট্রেস নিলে তো আর হয় না। তাই একজন যাতে ফেমিলিকে সময় দিতে পারে। 

স্বপ্ন ও কর্ম
স্বপ্ন ও কর্ম নিয়ে নাফিসা বলেন, এমবিবিএস শেষে কর্মজীবনের পথ বিস্তৃত—কারও গন্তব্য গবেষণায়, কেউ আবার বেছে নেন ক্লিনিক্যাল কাজ। কেউ কেউ আইসিডিডিআরবির মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন। আবার কেউ রোগীর কাছে সরাসরি সেবা দিয়ে গড়ছেন চিকিৎসা-জীবন। কিন্তু নাফিসা বলেন তার স্বপ্ন একটু ভিন্ন—তিনি হতে চান একজন সার্জন। তার ভাষায়, ‘আমার মনে হয়, সার্জন হলেই আসল ‘ডাক্তার’ হওয়ার অনুভবটা আসে। ছুরি-কাঁচির নিচে রোগীকে সুস্থ করে তোলার যে অভিজ্ঞতা—তা যেন অন্যরকম এক তৃপ্তি দেয়। সার্জারির প্রতি আমার ভিতর থেকে এক গভীর টান কাজ করে।’

Engineering and Science University থেকে আরও পড়ুন

ads
সর্বশেষ সংবাদ