facebook icon

গ্রাম থেকে শহরে—চুয়েটের দুই তরুণ পৌঁছে দিচ্ছেন রোবটিক্স সবার দোরগোড়ায়

সাইকা শুহাদা প্রকাশ: 09 June 2025, 07:39 PM , আপডেট: 10 June 2025, 12:15 AM
চুয়েটের দুই তরুণ পৌঁছে দিচ্ছেন রোবটিক্স সবার দোরগোড়ায়
চুয়েটের দুই তরুণ পৌঁছে দিচ্ছেন রোবটিক্স সবার দোরগোড়ায়   © টিডিসি

সাদামাটা একটি শ্রেণিকক্ষ। দেয়ালে ঝুলে থাকা রংচটা চার্টগুলোতে ধুলো জমে আছে, জানালা গলে ঢুকছে ম্লান বিকেলের আলো। কোণায় একটি কাঠের টেবিল, তার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সার্কিট বোর্ড, তার, ব্যাটারি আর ছোট ছোট যন্ত্রাংশ। টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে কিশোর-কিশোরীদের চোখে-মুখে একরাশ কৌতূহল। কেউ সোল্ডারিং আয়রনে তার জোড়া দিচ্ছে, কেউ বোঝার চেষ্টা করছে সেন্সর কীভাবে কাজ করে। বইয়ের পাতার বিজ্ঞান যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাদের সামনে।

এই দৃশ্য কোনো নামকরা শহুরে বিদ্যালয়ের নয়। এটি চট্টগ্রামের এক প্রত্যন্ত গ্রামের একটি স্কুলের। আর এই ব্যতিক্রমী দৃশ্যপটের পেছনে আছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই তরুণ—মো. রায়হানুল নাঈম ও জি এম ফয়সাল তাইসির। দুজনেই প্রযুক্তি ও যন্ত্রকৌশলের শিক্ষার্থী। তবে তাদের স্বপ্ন কেবল নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে নয়—তারা চান প্রযুক্তি হোক সবার জন্য, দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ুক জ্ঞানের আলো।

তাদের হাত ধরেই গড়ে উঠেছে সামাজিক উদ্যোগ Cypher Edge। এটি মূলত একটি প্রযুক্তি শিক্ষাভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে রোবটিক্স ও প্রযুক্তির জ্ঞান পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের ৫ তারিখে চট্টগ্রামের এক গ্রামের ছোট্ট একটি স্কুল থেকে যাত্রা শুরু করে এই উদ্যোগ। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

আরও পড়ুন: গুজবের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবো—উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

Cypher Edge মূলত শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজন করে "Robotics for Everyone" নামের কর্মশালা। যেখানে ছাত্রছাত্রীরা সরাসরি হাতে পায় মাইক্রোকন্ট্রোলার, সেন্সর, বোর্ড, বোট, তারসহ নানান সরঞ্জাম। তারা নিজেরাই তৈরি করে সরল রোবট, শিখে অটোমেশন ও প্রাথমিক কোডিং। এর ফলে বিজ্ঞান যে কেবল বইয়ের তত্ত্ব নয়, বরং বাস্তবজীবনের এক প্রয়োগ—সে উপলব্ধি জন্ম নিচ্ছে তাদের মনে।

এই উদ্যোগের অন্যতম দিক হলো, এতে অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের কোনো বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয় না। বরং 'Money Can’t Be a Barricade to Education'—এই স্লোগান সামনে রেখে Cypher Edge কম খরচে সরবরাহ করছে রোবটিক্স সরঞ্জাম, যাতে অর্থনৈতিক বাধা কাউকে পিছিয়ে না রাখে। প্রযুক্তি যেন কেবল শহরের অভিজাত শ্রেণির জন্য সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশু-কিশোররাও যাতে সহজে এই জগতে প্রবেশ করতে পারে—সেই চেষ্টাই করছে এই সংগঠন।

তবে এই উদ্যোগ কেবল শিক্ষার্থীদের নিয়েই সীমাবদ্ধ নয়। Cypher Edge স্থানীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। যাতে শিক্ষকরাও পাঠ্যবিষয় আরও জীবন্ত ও বাস্তবমুখী করে তুলতে পারেন। পাশাপাশি যারা নতুন প্রযুক্তি বা উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করতে চান, এমন উদ্যোক্তাদের জন্যও রয়েছে টেক অ্যাডভাইজরি ও পরামর্শমূলক সহায়তা।

এছাড়া, পাঠ্যবইভিত্তিক ব্যবহারিক উপকরণ তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবিষয়গুলো সহজ করে উপস্থাপন করার ব্যবস্থাও করছে এই সংগঠন। এসব উপকরণ শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিষয়ক ধারণাগুলো শুধু মুখস্থ না করে হাতে-কলমে শেখার সুযোগ করে দিচ্ছে, যা তাদের মধ্যে নতুন চিন্তাশক্তি গড়ে তুলছে।

Cypher Edge-এর সব কার্যক্রম জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDG) সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। সংগঠনটি মানসম্মত শিক্ষা (SDG 4), বৈষম্য হ্রাস (SDG 10) এবং প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন (SDG 9) লক্ষ্যে কাজ করছে। এর ফলে কেবল প্রযুক্তি শিক্ষাই নয়, বরং সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়নেও রাখছে ভূমিকা।

এই উদ্যোগের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা রায়হানুল নাঈম বলেন, “শৈশবে শুনতাম জাপানের শিশুরা রোবট বানায়, আর আমাদের শিশুরা শুধু ‘রোবট’ শব্দটা শুনেই বড় হয়। ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পায় না। আসলে প্রতিভার অভাব নেই, অভাব আছে সুযোগের। সেই সুযোগ করে দিতেই এই যাত্রা।”

অন্যদিকে, ফয়সাল তাইসির জানান, “আমরা চাই প্রযুক্তি শিক্ষা সবাই সহজে গ্রহণ করতে পারুক। এখন যারা রোবটিক্স নিয়ে কাজ করে, তারা মূলত বড় বড় বা ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে। আমরা সেটা ভাঙতে চাই। আমরা চাই, যেকোনো প্রান্তের শিক্ষার্থী প্রযুক্তি শিক্ষায় সমান সুযোগ পাক।”

ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে মে ২০২৫—এই ছয় মাসে Cypher Edge সফলভাবে সাতটি বিদ্যালয়ে কর্মশালা আয়োজন করেছে। অংশগ্রহণ করেছে শতাধিক শিক্ষার্থী। কম খরচে সরঞ্জাম সরবরাহ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা কার্যক্রমও সমানভাবে চলেছে।

Cypher Edge শুধু একটি শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম নয়—এটি এক ধরনের নীরব বিপ্লব। যেখানে গ্রামবাংলার শিশুরাও স্বপ্ন দেখছে প্রযুক্তির জগৎ নিয়ে, গড়ে তুলছে আত্মবিশ্বাস। তাদের চোখে এখন এক নতুন পৃথিবীর ছবি—যেখানে প্রযুক্তি কোনো বিলাসিতা নয়, বরং প্রত্যেকের অধিকার।

ads
সর্বশেষ সংবাদ