তবু মনটা বারবার টানছে—মা হয়তো এখনও পথে তাকিয়ে ভাবছে, ‘আমার ছেলে কবে আসবে’

যেখানে ঈদ মানেই প্রিয়জনের সঙ্গে উচ্ছ্বাসে মিশে যাওয়া, মায়ের হাতের রান্না, বাবার সঙ্গে নামাজে যাওয়া, ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে হাসিমুখে দিন কাটানো—সেই দৃশ্য থেকে বহু দূরে, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) কিছু শিক্ষার্থী এবার ঈদুল আজহার উৎসব কাটাচ্ছেন নিঃসঙ্গ ক্যাম্পাসে।
১ জুন থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ঈদের দীর্ঘ ছুটি থাকলেও, ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণের সংকল্পে তারা রয়ে গেছেন প্রিয়জনদের সান্নিধ্য থেকে দূরে। কারও সামনে সেমিস্টার ফাইনাল, কেউবা ব্যস্ত সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিতে। আবার কেউ ভিনদেশি, যাদের ঈদ কেবল চারপাশের মানুষের হাসিমুখ দেখেই অনুভব করতে হয়।
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী এস.এম. আশরাফুল আলম জায়েদ শাহ বললেন,‘ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা আর পারিবারিক টানাপোড়েন—এই দুইয়ের ভেতর দাঁড়িয়ে পরিবার থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত খুব কষ্টের হলেও বাস্তব। ঈদের দিনে বাবার কোল, মায়ের হাতের রান্না কিংবা ভাইবোনের সঙ্গে গৃহমন্দিরে বসে গল্প করার আনন্দকে ছেড়ে ক্যাম্পাসে পড়ে থাকাটা সহজ নয়।’
তবু হলের আবাসিক পরিবেশে কিছুটা প্রাণ ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। প্রতিবছরের মতো এবারও কোরবানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা মিলে নামাজ শেষে মাংস কাটেন, ভাগ করে নেন একে অপরের সঙ্গে ঈদের আনন্দ।
আরও পড়ুন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাবনায় পবিত্র ঈদুল আজহা
বিদেশি শিক্ষার্থী রাভি ইয়াদাভ, যিনি কৃষি বিভাগে পড়ছেন, নিজে মুসলমান না হলেও ক্যাম্পাসের ঈদের পরিবেশ তার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ‘আমি হিন্দু হলেও আমার মুসলিম বন্ধুরা যেভাবে ঈদ উদযাপন করে তা দেখার মধ্যে একধরনের মানবিক সৌন্দর্য আছে। এই সংস্কৃতি, এই আন্তরিকতা আমাকে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ করে তোলে। ঈদে না গেলেও, পাশে থেকে অনুভব করি বন্ধুত্বের এক অদ্ভুত উষ্ণতা।’
আরেক শিক্ষার্থী, ফলিত গণিত বিভাগের ১৪তম ব্যাচের একজন, প্রথমবারের মতো বাড়ির বাইরে ঈদ করছেন। কিছুটা অভিমান আর কিছুটা বাস্তবতার মিশেলে বললেন,
‘পাবনা থেকে আসা দূরত্ব, অর্থনৈতিক হিসেব-নিকেশ, সামনে পরীক্ষা—সবকিছু মিলে বুঝলাম এবার ঈদের আনন্দ একটু ত্যাগের হবে। তবু মনটা বারবার টানছে—মা হয়তো এখনও ছাদে তাকিয়ে ভাবছে, ‘আমার ছেলে কবে আসবে’।’
তবে দুঃখের মাঝে ভরসার আলো খুঁজে পাচ্ছেন তাঁরা বন্ধুত্ব, দায়িত্ববোধ এবং নিজের স্বপ্নের প্রতি অঙ্গীকারে। কেউ একসঙ্গে রান্না করছেন, কেউ বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন, কেউ আবার কেবল ঘরটা একটু সাজিয়ে তৈরি করছেন এক ‘ছোট্ট সংসার’, যেন উৎসবের ছোঁয়া একটুখানি হলেও অনুভব করা যায়।
হল ক্যান্টিনের ফাঁকা বেঞ্চ, নিস্তব্ধ ক্যাম্পাসের রাস্তাগুলো আর একেকটা নিঃশব্দ দুপুরে লুকিয়ে থাকা আকুলতা—সব কিছু মিলিয়ে ঈদটা হয়তো নিঃসঙ্গ, কিন্তু স্বপ্নের দিকে এগিয়ে চলার দৃঢ়তায় ভরপুর। তারা প্রমাণ করে দিচ্ছেন—ত্যাগ শুধু কুরবানির নয়, প্রিয়জনদের হাসিমুখ ছেড়ে স্বপ্নের টানে এগিয়ে যাওয়াটাও এক ধরনের কোরবানি।