হলে দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্বের পথে জাবিপ্রবি শিক্ষার্থী

জামালপুর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবিপ্রবি) মির্জা আজম (প্রস্তাবিত বিজয় ২৪) হলের আবাসিক ছাত্র ও ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মাশরুর জামান মোল্লা (রোশান) গোসল করতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে আহত হন। এ ঘটনায় জামালপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।
এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। জানা যায়, শিক্ষার্থী মাশরুর রোশান আজম হলের নিচতলার ১০৯ নম্বর কক্ষে থাকতেন। গত বৃহস্পতিবার (২৯ মে) দুপুরে গোসল করতে ওয়াশরুমে গেলে পা পিছলে পড়ে পায়ের গোড়ালীর রগ কাটা পড়ে। চিকিৎসকরা জানান, ৮২ দিন পা নাড়াচাড়া করতে পারবেন না মাশরুর। তবে এমন দুর্ঘটনা মাশরুরকে পঙ্গুত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে জানান চিকিৎসকরা।
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মাশরুরের বাবা মারা গেছেন ২০০৯ সালে। মা একটি বেসরকারি ক্লিনিকে চাকরি করেন। ক্যাম্পাসের সামনে ফটোকপির দোকান দিয়ে কোনোমতে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতেন মাশরুর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জড়িত মাশরুর অভ্যুত্থান পরবর্তী ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলনেও সম্মুখে ছিল। পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন ও পড়াশোনায় দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।
এদিকে এমন ঘটনার পর তোলপাড় উঠে নানা সমস্যায় জর্জরিত আজম হলের ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট সহকারী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ফরহাদ আলীর বিরুদ্ধে। প্রভোস্টের পদত্যাগ, হল সংস্কার, রোশানের চিকিৎসা ব্যয়ভার গ্রহণ এবং বড় ধরনের ক্ষতি হলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার দাবি ওঠে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপ ‘জামালপুর সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি ফ্যামিলি এবং জাবিপ্রবি শিক্ষার্থী সংসদ’ এ এমন দাবি তোলে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মিনহাজ লিখেন, ‘হল প্রভোস্টের পদত্যাগ চাই। হলের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য তাকে অনেকবার বলা হলেও বরাবরই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। যিনি ছোট্ট একটা হল পরিচালনা করতে পারেন না তাকে আমরা চাই না। শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে দ্রুত ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার মতো দক্ষ হল প্রভোস্ট চাই।’
শিক্ষার্থী ফারুক আহমেদ লিখেন, ‘একটা মাত্র ছোট হল। এই হলের ওয়াশরুমগুলো এতটা বাজে, আমি নিজেও ২/৩ বার পড়ে গিয়েছি। আজকে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো এসবের দায়ভার কে নিবে? হল প্রভোস্ট এই ছোট্ট একটা হলের ম্যানেজমেন্ট করতে পারে না। সত্যিই লজ্জাজনক।’
মনির আহমেদ লিখেন, ‘আমার প্রথম পরীক্ষার দিন আমি পড়ে গিয়ে প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে। বেসিনের পাইপ ফেটে গেছে। এটা সারতেও নাকি বাজেট লাগে।’
ফাহাদ আহমেদ লিখেন, ‘আজ এত মাস হয়ে গেল, এতবার অভিযোগ সমস্যার কথা বলা হলো, যেন মেজর প্রবলেমগুলো সলভ করেন। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো ইতিবাচক সাড়াই পাওয়া গেল না।’
আতিকুর রহমান লিখেন, ‘হল প্রভোস্ট এ দায় এড়াতে পারবেন না। তাকে জবাবদিহি করতেই হবে। হলের কোন উন্নয়ন দৃশ্যমান নেই।’ ফাহিম হোসেন লিখেন, ‘লিগ্যালি হল এলটমেন্টের জন্য আমি লিখিত আবেদন দিয়েছিলাম কিন্তু সাড়া পাইনি। লজ্জা থাকলে করে ফেলত (পদত্যাগ) এতদিন। চরম ব্যর্থ একজন প্রভোস্ট।’
জাবিপ্রবিতে ছাত্রদের একমাত্র আবাসিক এই হলে দীর্ঘদিন ধরে নানা সমস্যায় জর্জরিত বলে জানান একাধিক শিক্ষার্থী। নেই লিগ্যাল সিট বরাদ্দ, নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না পানির ট্যাংক, যার জন্য অনেকের চর্মরোগ হয়। বাথরুমের উপর পাইপ থেকে পানি পড়ে এবং অপরিচ্ছন্ন থাকে। নষ্ট হয় আছে খাবার পানির ফিলটার, নিম্নগতির ওয়াইফাই। নেই ওয়াশরুমে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। রুমের ভিতর রঙ খুলে পড়ে। হলে নেই ফার্স্ট এইড ও অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা।
এ ব্যাপারে আহত শিক্ষার্থী মাশরুর রোশান জানান, ‘প্রভোস্ট প্রচণ্ড দায়িত্বহীন লোক। হলের বিষয়ে অমনোযোগী। ক্লিনিং তো অন্তত সুন্দরভাবে করতে পারে। ক্লিনিংও কর্মচারীদের বকাঝকা করে আমাদের করিয়ে নিতে হয়। ঐ ভিসি স্যার যেদিন পরিদর্শনে আসেন কিংবা এখন আমি আহত হওয়ার পর পরিষ্কার করবে। পুরো ক্যাম্পাসে একজন মাত্র সুইপার।’
হল প্রভোস্টের পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাশরুর বলেন, ‘সিনিয়ররা যদি মনে করেন প্রভোস্টকে সরানো উচিত সরান।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলের ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট সহকারী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ফরহাদ আলী বলেন, ‘অনেকেই যেটা লিখেছে ভুল তথ্য লিখেছে। তারা কী লিখেছে এটা তাদের বিষয়। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিবে। রোশান ও তার মায়ের সাথে সার্বক্ষণিক কথা বলছি। কাল ভিসি স্যার আসলে তার চিকিৎসার ব্যয়ের ব্যাপারে আলোচনা হবে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দাবি জানিয়েছে এটা ঠিক। আমাদের প্রক্রিয়া চলমান। মোজাইক উঠিয়ে টাইলস করা হবে। হলে রং করা হবে, রাস্তা ও সাইকেল রাখার শেড নির্মাণ করা হবে। প্রসিডিউর এখনো শেষ তারপর টেন্ডারে গিয়ে কাজ শুরু হবে।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান জানান, ‘মাশরুরের সাথে কথা বলেছি। এ ব্যাপারে কাল বসবো, যথাসম্ভব হেল্প করার চেষ্টা করবো। আর হল রেনোভেশনের টেন্ডার এস্টিমেটেড হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে কয়েকদিনের মধ্যেই ইউজিসিতে যাবে এবং টেন্ডারিং হবে। হল বেশিরভাগই রেনোভেট করা হবে। টেন্ডারিং হওয়ার আগ পর্যন্ত যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখতে বলছি। প্রভোস্ট যদি প্রোপারলি কাজ না করে সেটাও দেখতে হবে।’